আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য সঠিক পথনির্দেশনা হিসেবে আল-কুরআন নাযিল করেছেন। তবে কুরআনের গভীর অর্থ ও নির্দেশনা বোঝার জন্য তাফসীর জানা জরুরি। তাফসীর এমন একটি জ্ঞান, যার মাধ্যমে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ও মর্মার্থ জানা যায়।
তাফসীরের সংজ্ঞা
আভিধানিক অর্থ:
- التَّفْسِيرُ → বাবে তাফয়ীলের মাসদার, অর্থ: ব্যাখ্যা করা, বিশ্লেষণ করা।
পারিভাষিক অর্থ:
اَلتَّفْسِيرُ هُوَ عِلْمٌ بِأُصُولٍ يُعْرَفُ بِهَا مَعْنَى كَلَامِ اللهِ عَلَى حَسَبِ الطَّاقَةِ بِالشَّرِيعَةِ
অর্থ: তাফসীর এমন একটি জ্ঞান, যার মাধ্যমে মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর বাণীর অর্থ বুঝতে পারে।
তাফসীরের ধরন
মূলত তাফসীর দুই ধরনের: التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ (বর্ণনামূলক তাফসীর)
التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ (যুক্তিভিত্তিক তাফসীর)
التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ (তাফসীর বিল মাসুর)
এটি সেই তাফসীর, যা কুরআন, হাদিস, সাহাবা ও তাবেয়ীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে করা হয়।
আভিধানিক অর্থ:
- المَأْثُورُ → বাবে ইফআল থেকে ইসমে মাফউল, অর্থ: বর্ণিত, সংরক্ষিত।
পারিভাষিক অর্থ:
اَلتَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ أَيْ الْمَنْقُولِ عَنِ الْقُرْآنِ وَالسُّنَّةِ وَالصَّحَابَةِ لِبَيَانِ مُرَادِ آيَاتِ اللَّهِ تَعَالَى
অর্থ: কুরআনের আয়াতের অর্থ বোঝাতে কুরআন, হাদিস ও সাহাবাদের বক্তব্যকে ভিত্তি করে যে ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাই তাফসীর বিল মাসুর।
التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ এর প্রধান চারটি উৎস:
تفسير القرآن بالقرآن → কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা কুরআনের মাধ্যমেই দেওয়া হয়।
- উদাহরণ: يوم الدين (বিচারের দিন) এর ব্যাখ্যা কুরআনেই এসেছে:
يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا (সেদিন কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারবে না)।
تفسير القرآن بالسنة → হাদিস দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা করা হয়।
- উদাহরণ: وَلَمْ يَلْبِسُوا۟ إِيمَـٰنَهُم بِظُلْمٍ আয়াতের “জুলুম” শব্দের ব্যাখ্যায় রাসুল (ﷺ) বলেছেন, এখানে শিরক বোঝানো হয়েছে।
تفسير القرآن بأقوال الصحابة → সাহাবাদের ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন বোঝানো হয়।
- উদাহরণ: ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন, “আযলাম” হলো কাঠি, যা দিয়ে ভাগ্য নির্ধারণ করা হতো।
تفسير القرآن بأقوال التابعين → তাবেয়ীদের ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন বোঝানো হয়।
- উদাহরণ: মুজাহিদ (رحمه الله) বলেছেন, তিনি ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর কাছে কুরআনের প্রতিটি আয়াতের ব্যাখ্যা জেনেছেন।
التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ (তাফসীর বির রায়)
এটি সেই তাফসীর, যা মুফাসসিরগণ কুরআন, হাদিস, ভাষাগত বিশ্লেষণ ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে করেন।
আভিধানিক অর্থ:
- الرَّأْيُ → বাবে ফাতহ থেকে মাসদার, অর্থ: মতামত, চিন্তা।
পারিভাষিক অর্থ:
اَلتَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ هُوَ اِجْتِهَادُ الْمُفَسِّرِ فِي فَهْمِ الْقُرْآنِ بِضَوَابِطِ الشَّرِيعَةِ وَاللُّغَةِ
অর্থ: কুরআনের আয়াত বোঝার জন্য শরীয়ত ও ভাষার নিয়ম মেনে যে ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাই তাফসীর বির রায়।
التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ এর তিনটি ধরন:
تفسير بالرأي المحمود (প্রশংসনীয় তাফসীর)
- এটি কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে হয় এবং শরীয়তের নিয়ম মেনে চলে।
- উদাহরণ: تفسير البيضاوي, تفسير الجلالين।
تفسير بالرأي المذموم (নিন্দনীয় তাফসীর)
- এতে ব্যক্তি নিজের মতামত বেশি প্রাধান্য দেয়, যা ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে মিল নেই।
تفسير بالرأي بين المحمود والمذموم (মিশ্র তাফসীর)
- এটি কখনো ভালো হয়, কিন্তু কখনো ব্যক্তিগত মত ও মাযহাবের পক্ষপাত থাকে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
উপসংহার
তাফসীর ছাড়া কুরআনের গভীর অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
সবচেয়ে নিরাপদ হলো التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ, কারণ এটি কুরআন, হাদিস ও সাহাবীদের ভিত্তিতে করা হয়।
التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে হয়।
কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা ও বিকৃত তাফসীর থেকে বাঁচতে নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরদের তাফসীর পড়া জরুরি।
আল্লাহ আমাদের কুরআনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমিন!