তাফসীর: সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য সঠিক পথনির্দেশনা হিসেবে আল-কুরআন নাযিল করেছেন। তবে কুরআনের গভীর অর্থ ও নির্দেশনা বোঝার জন্য তাফসীর জানা জরুরি। তাফসীর এমন একটি জ্ঞান, যার মাধ্যমে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ও মর্মার্থ জানা যায়।


তাফসীরের সংজ্ঞা

✅ আভিধানিক অর্থ:

  • التَّفْسِيرُবাবে তাফয়ীলের মাসদার, অর্থ: ব্যাখ্যা করা, বিশ্লেষণ করা।

✅ পারিভাষিক অর্থ:
اَلتَّفْسِيرُ هُوَ عِلْمٌ بِأُصُولٍ يُعْرَفُ بِهَا مَعْنَى كَلَامِ اللهِ عَلَى حَسَبِ الطَّاقَةِ بِالشَّرِيعَةِ
অর্থ: তাফসীর এমন একটি জ্ঞান, যার মাধ্যমে মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর বাণীর অর্থ বুঝতে পারে।


তাফসীরের ধরন

মূলত তাফসীর দুই ধরনের:
1️⃣ التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ (বর্ণনামূলক তাফসীর)
2️⃣ التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ (যুক্তিভিত্তিক তাফসীর)


التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ (তাফসীর বিল মাসুর)

এটি সেই তাফসীর, যা কুরআন, হাদিস, সাহাবা ও তাবেয়ীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে করা হয়।

✅ আভিধানিক অর্থ:

  • المَأْثُورُবাবে ইফআল থেকে ইসমে মাফউল, অর্থ: বর্ণিত, সংরক্ষিত।

✅ পারিভাষিক অর্থ:
اَلتَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ أَيْ الْمَنْقُولِ عَنِ الْقُرْآنِ وَالسُّنَّةِ وَالصَّحَابَةِ لِبَيَانِ مُرَادِ آيَاتِ اللَّهِ تَعَالَى
অর্থ: কুরআনের আয়াতের অর্থ বোঝাতে কুরআন, হাদিস ও সাহাবাদের বক্তব্যকে ভিত্তি করে যে ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাই তাফসীর বিল মাসুর।

📌 التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ এর প্রধান চারটি উৎস:
1️⃣ تفسير القرآن بالقرآن → কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা কুরআনের মাধ্যমেই দেওয়া হয়।

  • উদাহরণ: يوم الدين (বিচারের দিন) এর ব্যাখ্যা কুরআনেই এসেছে:
    يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا (সেদিন কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারবে না)।

2️⃣ تفسير القرآن بالسنة → হাদিস দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা করা হয়।

  • উদাহরণ: وَلَمْ يَلْبِسُوا۟ إِيمَـٰنَهُم بِظُلْمٍ আয়াতের “জুলুম” শব্দের ব্যাখ্যায় রাসুল (ﷺ) বলেছেন, এখানে শিরক বোঝানো হয়েছে।

3️⃣ تفسير القرآن بأقوال الصحابة → সাহাবাদের ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন বোঝানো হয়।

  • উদাহরণ: ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন, “আযলাম” হলো কাঠি, যা দিয়ে ভাগ্য নির্ধারণ করা হতো।

4️⃣ تفسير القرآن بأقوال التابعين → তাবেয়ীদের ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন বোঝানো হয়।

  • উদাহরণ: মুজাহিদ (رحمه الله) বলেছেন, তিনি ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর কাছে কুরআনের প্রতিটি আয়াতের ব্যাখ্যা জেনেছেন।

التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ (তাফসীর বির রায়)

এটি সেই তাফসীর, যা মুফাসসিরগণ কুরআন, হাদিস, ভাষাগত বিশ্লেষণ ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে করেন।

✅ আভিধানিক অর্থ:

  • الرَّأْيُবাবে ফাতহ থেকে মাসদার, অর্থ: মতামত, চিন্তা।

✅ পারিভাষিক অর্থ:
اَلتَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ هُوَ اِجْتِهَادُ الْمُفَسِّرِ فِي فَهْمِ الْقُرْآنِ بِضَوَابِطِ الشَّرِيعَةِ وَاللُّغَةِ
অর্থ: কুরআনের আয়াত বোঝার জন্য শরীয়ত ও ভাষার নিয়ম মেনে যে ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাই তাফসীর বির রায়।

📌 التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ এর তিনটি ধরন:
1️⃣ تفسير بالرأي المحمود (প্রশংসনীয় তাফসীর)

  • এটি কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে হয় এবং শরীয়তের নিয়ম মেনে চলে।
  • উদাহরণ: تفسير البيضاوي, تفسير الجلالين

2️⃣ تفسير بالرأي المذموم (নিন্দনীয় তাফসীর)

  • এতে ব্যক্তি নিজের মতামত বেশি প্রাধান্য দেয়, যা ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে মিল নেই।

3️⃣ تفسير بالرأي بين المحمود والمذموم (মিশ্র তাফসীর)

  • এটি কখনো ভালো হয়, কিন্তু কখনো ব্যক্তিগত মত ও মাযহাবের পক্ষপাত থাকে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

উপসংহার

✅ তাফসীর ছাড়া কুরআনের গভীর অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
✅ সবচেয়ে নিরাপদ হলো التَّفْسِيرُ بِالْمَأْثُورِ, কারণ এটি কুরআন, হাদিস ও সাহাবীদের ভিত্তিতে করা হয়।
✅ التَّفْسِيرُ بِالرَّأْيِ তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে হয়।
✅ কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা ও বিকৃত তাফসীর থেকে বাঁচতে নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরদের তাফসীর পড়া জরুরি।

📖 আল্লাহ আমাদের কুরআনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমিন! 🤲